“আমরা গ্র্যাজুয়েট, আমরা বেকার, আমরা অনাহারক্লিষ্ট। আমাদের পেটে লাথি মারবেন না,” এ ছিল এক সহকর্মীর উদ্দেশ্যে এই সপ্তাহেই পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের এক তরুণের মন্তব্য।

তার এই ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা গেছে এর পরের তিনদিন ভারতের অনগ্রসর রাজ্যগুলোর একটি বিহারের বেশ কয়েকটি জেলায়। চাকরিকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় বারোটির মত জেলায়।

ভারতের সবচেয়ে বড় চাকুরিদাতা ভারতীয় রেলে ৩৫ হাজার শূন্য পদের জন্য আবেদন জমা পড়ে এক কোটিরও বেশি, যার বড় অংশই ছিল বিহার আর উত্তরপ্রদেশ থেকে।

বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা বলছেন নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল অস্বচ্ছ এবং সমস্যা জর্জরিত। যাদের পদের জন্য যোগ্যতা বেশি, তাদেরও কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের সঙ্গে একসাথে আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এর ফলে তৈরি হয় হতাশা। হতাশা রূপ নেয় ক্ষোভে এবং ক্ষোভ থেকে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা।

রেল কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেয়, এবং বিক্ষুব্ধ আবেদনকারীদের হুমকি দেয় যে ভবিষ্যতে ভারতীয় রেলের চাকরির পরীক্ষায় তাদের বসতে দেয়া হবে না।

একটি সংবাদপত্র বলছে এই বিক্ষোভকে শুধু নিয়োগের অনিয়ম বা চাকরির সঙ্কটের আলোকে দেখলে চলবে না, “বেকারত্ব তরুণ প্রজন্মের ওপর যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, এই প্রতিবাদ সেটারই বহিঃপ্রকাশ”।

আমার সহকর্মীকে একজন বিক্ষোভকারী বলেছেন, তার বাবা কৃষক। তার জমি বেচে তিনি ছেলেকে পড়িয়েছেন। তার মা যখন অসুস্থ হয়েছেন, মা ওষুধ কেনেননি, যাতে শহরে ছেলের ঘর ভাড়া এবং প্রাইভেট কোচিং-এর জন্য হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৮ সালে একটি উক্তি করেছিলেন – ‘ছোটখাট পাকোড়ার দোকান দেয়াও একটা চাকরি’। ওই তরুণ সেই উক্তি নিয়ে ব্যঙ্গ মন্তব্য করে বলেছেন, “স্নাতক পাশ করা ছেলেমেয়েদের কেন আপনি পাকোড়ার দোকান দিতে বলবেন?”

নানা দিক দিয়ে, এই তরুণের ক্ষোভ এবং সাম্প্রতিক সহিংস বিক্ষোভ ভারতে বেকারত্বের চরম সঙ্কটকে সামনে এনেছে।

‘সরকারের টনক নড়া উচিত’

অনেকে মনে করছেন, এ সপ্তাহে ভারত এবং উত্তর প্রদেশে চাকরিকে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গা হয়েছে তাতে সরকারের টনক নড়া উচিত। ভারতে বেকারের এক চতুর্থাংশই এই দুটি জনবহুল রাজ্যের বাসিন্দা।

Presentational white space
ভিডিওর ক্যাপশান,উত্তর প্রদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জ
Presentational white space

তবে, তার মানে এই নয় যে বিহার ও উত্তর প্রদেশের বাইরে অন্য রাজ্যে কাজের সুযোগ রয়েছে।

ডিসেম্বর মাসে ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছয় প্রায় আট শতাংশে। এই হিসেব দেয় নিরপেক্ষ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)। এই হার ২০২০ সালে এবং ২০২১এর বেশিটা জুড়ে ছিল সাত শতাংশের ওপর।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন অন্তত গত তিন দশকে বেকারত্বের এই পরিসংখ্যান দেখা যায়নি।

কর্মক্ষম বয়সের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছেন, তাদের সংখ্যা কমে গেছে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে মাত্র ২৭% হয় কাজ করছেন নয়ত কাজের সন্ধান করছেন।

যে ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তার বেকার থাকার সম্ভাবনাও তত বেশি। তারা কম বেতনের এবং ঝুঁকি আছে এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কোন চাকরি নিতে অনাগ্রহী।

ভারতে কর্মক্ষম জনশক্তিতে ১৫ এবং ১৫-ঊর্ধ্ব নারীর অনুপাত পৃথিবীতে অন্য সব দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম।

কোচিং ক্লাসের বিজ্ঞাপন

ছবির উৎস,VISHNU NARAYAN

বিহারের রাজধানী পাটনায় উঁচু ভবনগুলোর মাথা ছেয়ে গেছে কোচিং ক্লাসের বিজ্ঞাপনে

বেকারদের সিংহভাগই তরুণ

ভারতে বেকারত্বের প্রকোপে সবচেয়ে নাজেহাল ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ প্রজন্ম।

এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি শিশু কিশোর স্কুলে যায় এবং কলেজে লেখাপড়া করে। ফলে ভারতে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, বলছেন শ্রম বিষয়ক অর্থনীতিবিদ রাধিকা কাপুর।

“এটা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোন সমস্যা নয়, অনেকদিন ধরেই এই সঙ্কট একটু একটু করে দানা বাঁধছিল,” তিনি বিবিসিকে বলেন।

ভারতে, এক কথায়, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না- বিশেষ করে তরুণদের জন্য মানসম্পন্ন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। শ্রম জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, তরুণদের এক চতুর্থাংশই ঘরে বসে কাজ করছেন- “বিনা বেতনের সাংসারিক কাজ”। এক কথায় তারা পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করছেন আর বাকি সময়ে পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন।

মাত্র এক তৃতীয়াংশ নিয়মিত চাকরি করেন। কিন্তু এদের মধ্যে ৭৫ শতাংশের চাকুরিতে নিয়োগ সংক্রান্ত কোন চুক্তিপত্র নেই এবং ৬০ শতাংশের বেশি কর্মী সামাজিক কোনরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় পড়েন না অর্থাৎ চাকুরি না থাকলে তাদের জন্য কোনরকম ভাতার ব্যবস্থা নেই।

Presentational grey line
বেকারত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

ছবির উৎস,AFP

২০২১ সালের বেশিরভাগটা জুড়েই ভারতে বেকারত্বের হার ছিল ৭%এর ওপর

ভারতীয় রেলের মত সরকারি চাকুরি পাবার জন্য তরুণদের এই মরীয়া হয়ে ওঠা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে ভারতের তরুণরা নিশ্চিত এবং নিরাপত্তা আছে এমন কাজ পেতে বেশি আগ্রহী। তারা চটক আছে, কিন্তু ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা আছে এমন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় না, বলছেন ড. কাপুর।

“এসব চটকদার কাজে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকলেও অনিশ্চয়তা আছে, ঝুঁকি আছে, সুনির্দিষ্ট পথে কেরিয়ার গড়ার সম্ভাবনা নেই। শিক্ষিত তরুণ সমাজের কাছে এসব কাজের আকর্ষণ নেই। এধরনের কাজে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে বেকারত্ব সমস্যা বা কর্মসংস্থানের সঙ্কট সমাধান করা যাবে না।”

তরুণদের আদর্শ চাকুরির স্বপ্ন

বিহারের মত রাজ্যে কৃষিতে ক্রমবর্ধমান সমস্যা কর্মসংস্থানের সঙ্কট আরও প্রকট করে তুলেছে। জমির মালিকানা কমে গেছে। কৃষিকাজ অর্থকরী নয়।

কৃষিজীবী পরিবারগুলো তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছে এবং টাকা ধার করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য শহরে পাঠাচ্ছে। প্রাইভেট কোচিং-এর জন্যও তারা ধারকর্জ করছেন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই তরুণরাই এসব পরিবারের প্রথম প্রজন্ম যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো দেখছেন। তারা অফিস আদালতে বা কোন সংস্থায় কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে বড় হচ্ছেন। অথচ ভারতের অর্থনীতিতে এদের জন্য এধরনের কর্মসংস্থানের বড়ধরনের অভাব রয়েছে।

এর উপর রয়েছে সরকারি স্কুল এবং কলেজে শিক্ষার উল্লেখযোগ্য নিম্ন মান, যা এসব শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত সম্পর্কে তেমন আস্থা যোগাতে পারছে না।

ফলে বিহারের রাজধানী পাটনার উঁচু উঁচু ভবনগুলোর মাথা ছেয়ে গেছে প্রাইভেট কোচিং স্কুলের বিজ্ঞাপনে। তারা এসব শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির পরীক্ষা পাশে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

এদিকে, শিক্ষকরা এই শিক্ষার্থীদের এমন কথাও বলছেন যে অদূর ভবিষ্যতে তাদের চাকরির কোন আশা নেই। বিহারের এই দাঙ্গায় উস্কানি দেবার জন্য পুলিশ তাদের অভিযোগনামায় কোচিং স্কুলের ছয়জন শিক্ষককে অভিযুক্ত করেছে।

 

ভারতীয় রেল নেটওয়ার্ক

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ভারতের বহু তরুণ ভারতীয় রেলের মত সরকারি চাকুরি পাবার জন্য মরীয়া

তরুণদের অভিযোগ ‘সরকার নিশ্চুপ’

এ সপ্তাহে ভারতীয় রেলে নিযুক্তির একটি পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে দেশটির কয়েকটি রাজ্যে প্রধানত নেতৃত্ববিহীন এবং স্বতঃস্ফুর্ত যেসব দাঙ্গা হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো চাকুরির সঙ্কট যে কী ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিহারের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভে কেউ কর্ণপাত না করায় তারা পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন।

ভারতের বিভিন্ন শহরে চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে বেকারত্বের কারণে পারিবারিক সহিংসতা অনেক বেড়ে গেছে।

কোন কোন জরিপ অবশ্য একথাও বলছে যে “পারিবারিক সহিংসতার পেছনে কারণ হিসাবে সচরাচর বেকারত্ব এবং নিম্ন আয়ের কাজকে যে জড়ানো হয়, এমন দাবির সঙ্গত কোন ভিত্তি নেই। এমনকি সহিংসতা বা যুদ্ধের কারণ হিসাবেও বেকারত্বকে জড়িয়ে ফেলা সবসময় সঠিক নয়।”

তবে একথা ভুললে চলবে না যে, ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে গণ-অসন্তোষ দমনে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন – নাগরিকের স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নিয়ে হাজার হাজার মানুষকে কারাবন্দী করেছিলেন, সেই অসেন্তাষের সূত্রপাত হয়েছিল চাকুরির অভাব এবং চড়া মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে।

জরুরি অবস্থার গোড়ার দিকে চালানো এক জরিপে দেখা গিয়েছিল সেসময় ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী প্রায় ২৪ শতাংশ তরুণ ছিলেন বেকার।

ভারতীয় গণতন্ত্রের সেই কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল যে প্রতিবাদ আন্দোলনের হাত ধরে, সবচেয়ে বড় সেই বিক্ষোভগুলোর বেশিরভাগই হয়েছিল ভারতের বিহার রাজ্যে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা